বাংলাদেশ, সেভেন সিস্টার্স এবং আরাকান অঞ্চল: সংঘাতের সংক্ষিপ্ত আদ্যোপান্ত


বাংলাদেশ, সেভেন সিস্টার্স এবং আরাকান অঞ্চল: সংঘাতের সংক্ষিপ্ত আদ্যোপান্ত

                                                         ॥ আই, বি, এস ছিদ্দিকী ইউবিন ॥

তৎকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সাইরিল র‌্যাডক্লিফ এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কারণে বর্তমানের বাংলাদেশ কতটা ব্যাকফুটে পড়েছে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো বাংলাদেশের সাথে পার্শ্ববর্তী দেশের নর্থ-ইস্টের সাতটা রাজ্য এবং মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের সম্পর্ক।

খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলাদেশের সাথে ভারতের নর্থ-ইস্টের রাজ্যগুলোর সীমানা এমন ভাবে দাগ কাঁটা, যেখানে সুন্দর পাহাড় বেষ্টিত জায়গাগুলো সব ভারত কিংবা মায়ানমারের ভাগে পড়েছে যা সেদেশের জন্য একটি প্রতিরক্ষা দূর্ঘ হিসেবে কাজ করে, আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কিংবা বর্তমান বাংলাদেশের ভাগে পড়েছে ভালনারেবল কিংবা নিচু জায়গাগুলো, যেখানে সর্বদা বন্যা লেগে থাকে কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ কম।

লক্ষ্য করলে বুঝবেন, র‌্যাডক্লিফ তৎকালীন বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছুটা অসৎ চালাকি করলেন। তিনি পশ্চিম বঙ্গ থেকে নর্থ-ইস্টের রাজ্যগুলোর বর্ডারলাইন এভাবে সেট করলেন যেনো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ভারতের অনন্তকালের একটা সংঘাত লেগে থাকুক।

টিম মার্শাল তার প্রিজনার্স অব জিওগ্রাফি বইটিতে ঠিক এই কথাটিই বলেছেন। দুটো দেশের সীমানা নির্ধারণের ম্যাকানিজম দুটো দেশকে যুগ যুগ ধরে সংঘাতে জড়িয়ে রাখতে পারে এবং সেখানে রাশিয়ার সাথে পশ্চিম ইউরোপের সংঘাতের কারণ খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করলেন।

বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ছিল প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত। বর্তমান কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং ফেনীর কিছু জায়গা এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য নিয়ে সমতট জনপদ গঠন হয়েছিল।

কিন্তু বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের মাধ্যমে সাইরিল র‌্যাডক্লিফ সীমানা এভাবে ভাগ করেন, যেখানে বাংলাদেশের পূর্ব দিকে সীমানার ভেতরেই ত্রিপুরা রাজ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশের পেটের মধ্যেই ত্রিপুরা রাজ্য।

আবার দেখবেন, কক্সবাজারের কিছু অংশ ছিল তৎকালীন আরকান রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত যা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার অধীনে ছিল। কিন্তু র‌্যাডক্লিফ এভাবে কক্সবাজারের সীমানা নির্ধারণ করেন যেখানে মায়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সংঘাত তৈরি হওয়া খুব সহজ।

অথচ নিয়ম অনুযায়ী ভারতের নর্থ-ইস্টের রাজ্যগুলোর অধিকাংশ বাংলাদেশের হওয়ার কথা ছিল। যদি এসব বাংলাদেশের হতো, তাহলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের তেমন সংঘাতের কারণই থাকতো না। আবার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মায়ানমারের আরাকান রাজ্যও বাংলাদেশের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে র‌্যাডক্লিফ ইচ্ছেকৃত ভাবে এই অঞ্চলে সংঘাত সৃষ্টি হয়, এরকম বর্ডারলাইন তৈরি করলেন।

এর জন্য জিন্নাহও অবশ্য কিছুটা দায়ী। লোকমুখে প্রচলিত, তৎকালীন স্বাধীন কাশ্মীর অঞ্চলকে হাতে পাওয়ার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং র‌্যাডক্লিফের সাথে ডিল করেন জিন্নাহ, এবং তিনি কাশ্মীরের জন্য বর্তমান আরাকান অঞ্চলকে সেক্রিফাইস করেন।

আর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রী ছিল জওহরলাল নেহেরুর অত্যন্ত কাছের বন্ধু। সেই সুবাধেও মাউন্টব্যাটেন এবং র‌্যাডক্লিফ ভারতকেই বেশি সুবিধা প্রদান করেছে বলা যায়।

এসব সমস্যা ডিল করার জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার, তা হলো দক্ষ এবং শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং কমনসেন্সে আছে এরকম শিক্ষিত যুব সমাজ। তা নাহলে বাংলাদেশের জন্য সামনে কঠিন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আমরা যদি এতসব আন্দোলনের নামে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে থাকি, তাহলে তা কখনো দেশে স্থিতিশীলতা আনবে না। আমাদের তাই দরকার জেন্টেলম্যানস এগ্রিমেন্ট ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। 

লেখক: আই, বি, এস ছিদ্দিকী ইউবিন

আইবিএস রিসার্চ

বিবিএ, এমবিএ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 


Post a Comment

0 Comments