রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেপরোয়া ‘হালিম গ্রুপ’ এর অত্যাচার-নিপীড়নে অতিষ্ট সারাধন রোহিঙ্গারা

মোহাম্মদ সেলিম : ক্যাম্প-২, ক্যাম্প-৭ এবং বালুখালীর ক্যাম্প-৮ ইস্টসহ উখিয়ার একাধিক ক্যাম্পে নতুন করে অপহরণ, ইয়াবা বানিজ্য, চাঁদাবাজি এবং সাধারণ রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে ‘হালিম গ্রুপ’ এর সদস্যরা।

উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে সম্প্রতি উত্থান হওয়া ‘হালিম গ্রুপ’ নামের এই সশস্ত্র গোষ্ঠী নতুন করে একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালালেও ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত এপিবিএন কর্তৃক দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ফলে আরও বেপরোয়া হয়ে প্রকাশ্যে জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে বাহিনী প্রধান আব্দুল হালিম ও তার দলের সদস্যরা। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরসা’ থেকে বেরিয়ে ‘হালিম গ্রুপ’ গ্রুপ নামে নিজের নামানুসারে নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরী করেন আব্দুল হালিম। ক্যাম্পের একাধিক মাঝি ও বিভিন্ন সংগঠনের হয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, গত কয়েকমাসে উখিয়া এবং বালুখালীর একাধিক ক্যাম্পে নতুন করে নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করছে গ্রুপটি। 

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, হালিম গ্রুপের প্রধান আব্দুল হালিমের মূল নাম কেফাউত উল্লাহ। তিনি রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন ‘আরসা’র ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন। আব্দুল হালিমের পিতার নাম বাদশা মিয়া, তিনি মংডুর নাফ্ফুরা পাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। ২০১৭ সালের আগে মিয়ানমারে থাকা অবস্থায় আব্দুল হালিম আরসা’র অন্যতম দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর ‘আরসা’ প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনীর অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আব্দুল হালিম। অভিযোগ রয়েছে ২০২১ সালে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল এই দুর্ধর্ষ আব্দুল হালিম। এই ঘটনার পর আরসার ভিতরে ফাটল সৃষ্টি হলে আব্দুল হালিম তাঁর অনুসারীদের নিয়ে আরসা থেকে বের হয়ে নিজেই তৈরি করেন হালিম গ্রুপ। 

ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা জানান, নব্য প্রকাশ্যে আসা হালিম গ্রুপের সদস্যরা এতোটাই ভয়ঙ্কর যে, প্রকাশ্য দিন-দুপুরে সাধারন রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে লুটপাট, ধর্ষণ, জুলুম চালালেও তাদের বিরুদ্ধে সিআইসি বা এপিবিএন পুলিশের কাছে অভিযোগ দেয়া যায়না। কেউ অভিযোগ করলে তাকে অপহরন করে হত্যা ও লাশ গুম করার ভয় দেখিয়ে শারিরিক নির্যাতন চালিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা মুক্তিপন আদায় করা হয়। হালিম বাহিনীর এসব অত্যাচার মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর অত্যাচারকেও হার মানায় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা।  

জানা যায়, সম্প্রতি হালিম গ্রুপ এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় কয়েকটি পরিবারে হামলা ও লুটপাট চালিয়ে অস্ত্রের মুখে নারীদের শ্লীলতাহানী করে বাড়ি থেকে বের করে দেন দূর্ধর্ষ আব্দুল হালিম।  

হালিম গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মূল নেতৃত্বে রয়েছে- তারই সেকেন্ড ইন কমান্ড আইয়ুব নুর ওরফে টুপি নুর। অভিযোগ রয়েছে, আব্দুল হালিমের পক্ষ হয়ে ইয়াবা এবং অস্ত্র সংগ্রহ ও পাচারের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করেন এই আইয়ুব নুর। তার নেতৃত্বে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ,লুটপাট, চাঁদা হিসেবে রোহিঙ্গাদের রেশন কেড়ে নেওয়াসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালিত হয়।  

শুধু আধিপত্য বিস্তার নয়, হালিম গ্রুপের সদস্যরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়ে বসিয়েছে মাদক ব্যবসার গোপন জাল, প্রতিটি ক্যাম্পেই মাদক বহনের এবং বিক্রির জন্য তাদের রয়েছে আলাদা বাহিনী।

আইনশৃংখলা বাহিনীর তথ্য বলছে, ক্যাম্প-৭ ও আশেপাশের কয়েকটি ক্যাম্পে হালিম গ্রুপের ব্যাপক আধিপত্য রয়েছে। এছাড়াও নতুন করে বিভিন্ন ক্যাম্পগুলোতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে এই হালিম বাহিনী।  

সুত্র মতে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃংখলা বাহিনী কঠোর অবস্থান নিলে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম কিছুটা শীতীল থাকলেও সম্প্রতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বাহিনীগুলো। 

পুলিশ জানায়, হালিম গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের নেতা মাষ্টার মুহিব উল্লাহ, মুফতি মৌলানা আব্দুল্লাহ, মুফতি হাসিম, আরিফ উল্লাহ, হাফেজ শফিকসহ অসংখ্য হত্যা মামলার আসামী এই আব্দুল হালিম। 

বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাম্পে হালিম গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তারা হলেন, আমির রফিক, ফজল কবির ওরফে আবু আনাস, মৌলভী শোহাব ওরফে হাফেজ হামিদ হোসেন, নুুরুল বশর, হাফেজ সাইফুল, রাহামত উল্লাহ।

স্থানীয়দের অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি রবিউল হোসাইন বলেন, ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কার্যক্রমগুলোর কার্যক্রম কিছুদিন কমে গেলেও আবারো নতুন করে তাঁদের সক্রিয় হওয়াটা রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়ের জন্যও বিষয়টি দুঃশ্চিন্তার।

১৪ এপিবিএন এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ সিরাজ আমিন গনমাধ্যমকে জানান, কোনো গ্রুপ যদি ক্যাম্পে নতুন করে আইনশৃংখলা বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করে এপিবিএন কঠোরভাবে দমন করবে।


Post a Comment

0 Comments