উখিয়ায় চাকুরিচ্যুত শিক্ষকদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ, আহত ১৫, আটক ২৭ : রাজনৈতিক নেতাদের জিম্মায় মুক্তি

হেলাল উদ্দিন, উখিয়া: কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকরিচ্যুত স্থানীয় শিক্ষকদের আন্দোলন ঘিরে বুধবার (২০ আগস্ট) দিনভর উত্তেজনা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় অন্তত: ১৫ জন আগত হয়েছে। এসময় অন্তত ২৭ আন্দোলনকারীকে আটক করেছে উখিয়া থানা পুলিশ। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারীদের সাথে যোগ দেন স্থানীয়রাও। এক পর্যায়ে আটককৃতদের উদ্ধার করতে থানা কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ে আন্দোলনকারীসহ শতশত জনতা। ফলে দফায় দফায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে উত্তেজিত জনতার উপর। পরে রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে আটককৃতদের ছেড়ে দেয়া হয়। 

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে শহীদ মিনার ও ক্যাম্প সংলগ্ন সড়কে অবস্থান নিলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরাতে গেলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। একপর্যায়ে লাঠিচার্জ চালিয়ে ২৭ জন শিক্ষককে আটক করে পুলিশ। এসময় অন্তত ১৫ জন শিক্ষক আহত হয়। আহতদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা শুরুতর হলে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করে। 

আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছিলেন, কিন্তু পুলিশ অকারণে বলপ্রয়োগ করেছে। চাকরিচ্যুত শিক্ষক সাজেদুল হক বলেন, আমরা তিন মাস ধরে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছি। বারবার আশ্বাসের পরও সমাধান হয়নি। আজও আমার আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছিম কিন্তু পুলিশ বিনা কারণে আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশের ধাওয়া খেয়ে এক নারী শিক্ষক চিৎকার করে বলছেন, এই মরি গিওই।পরে জানা যায়, তিনি গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ঘটনার পরপরই রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

এদিকে দুপুর ২ টার দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে  উখিয়া উপজেলা বিএনপির আহবায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরী ও সদস্য সচিব সোলতান মাহমুদ চৌধুরী'র নেতৃত্বে উপজেলা বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল থানায় আসে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করে। পরে উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আবুল ফজলের নেতৃত্বে জমাতের একটি টিম থানায় প্রবেশ করে। এর আগে দুপুর ১ টার জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি'র কেন্দ্রীয় নেতা সুজা উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি টিম থানায় উপস্থিত হন।

উপস্থিত সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, শিক্ষক প্রতিনিধি, পুলিশ প্রশাসন, ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডমিন) শাকিব, উখিয়া থানার ওসি আরিফ হোসাইন,উখিয়া উপজেলা বিএনপির আহবায়ক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরী, সদস্য সচিব সোলতান মাহমুদ চৌধুরী, উখিয়া উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা আবুল ফজল,এনসিপি কেন্দ্রীয় নেতা এসএম সুজা উদ্দিন, সাদমান জামী চৌধুরী, নায়েবে আমীর মাওলানা নুরুল হকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজনৈতিক নেতাদের জিম্মায় আটককৃত ২৭ শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে মুক্তি দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক আন্দোলনের সমন্বয়ক শামীম ও জুলাই আন্দোলনের সম্মুখযোদ্ধা জিনিয়া শারমিন রিয়া।

শিক্ষক আন্দোলনকারীরা বৈঠক শেষে আটককৃতদের মুক্ত করে থানা থেকে বের হয়ে উখিয়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষক প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা সহ এক প্রেস কনফারেন্সে করে আপাতত ২৬ আগস্ট পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন। 

এসময় উপজেলা বিএনপির আহবায়ক সরওয়ার জাহান চৌধুরী বলেন,রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের যৌক্তিক আন্দোলনের সাথে তারা আগেও ছিল এখনো আছে। আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর নেক্কারজনক হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। 

এই ঘটনায় যে সকল পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনার জোর দাবি জানান। এনসিপি'র নেতা সুজা উদ্দিন বলেন,উখিয়া বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরের কোন অংশ নয় যে এখানে কোন ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করা যাবে না। শিক্ষকদের এই আন্দোলনে তিনি পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন এবং তিনি আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর যে পুলিশ কর্মকর্তা বল প্রয়োগ করেছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবেও জানান তিনি।

শিক্ষক প্রতিনিধ সাইদুল ইসলাম শামীম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন-আগামী ২৭ আগষ্ট যে সময় দেওয়া হয়েছে সে সময়ের মধ্যে চাকরিতে পুনর্বহালের কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না এলে তারা আরও কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে এবং আপাতত সকলকে শান্ত থাকার আহ্বান। 

পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আন্দোলনকারীরা গত ১৮ আগষ্ট থেকে আবারো চাকরিতে পূর্ণবহালের দাবি নিয়ে সড়ক অবরোধ করে  সেই দিন তার দিনভর কক্সবাজার-টেকনাফ মহা সড়ক অবরোধ করে রেখেছিন কিন্তু জেলা পুলিশ ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করেছে। তাদের বুঝানো হয়েছে আগামী ২৫ তারিখ অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কক্সবাজার সফর উপলক্ষ্যে তারা যেন সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে। 

কিন্তু বুধবার (২০ আগষ্ট) সকাল থেকে আবার সড়ক অবরোধ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন  সংস্থার গাড়ি ক্যাম্প প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। তাদের কারণে সড়কে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হওয়ায় পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ও জানমালের নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নিতে হয়েছে এবং আন্দোলনকারীদের থেকে ২৭ জনকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছিল। 

পরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে আগামী ২৫ তারিখ পর্যন্ত সড়কে কোনো বিশৃঙ্খলা করবে না এই শর্তে আটককৃতদের মুক্তি দেওয়া হয় বলে জানায়।

ইউনিসেফের অর্থায়নে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিচালিত শিক্ষা প্রকল্পের একাংশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি প্রায় ১ হাজার ২০০ স্থানীয় শিক্ষক চাকরি হারান। এর পর থেকেই তারা চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

উখিয়ায় চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জ ও আটকের ঘটনায় উখিয়া জুড়ে থমথমে ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করে।


Post a Comment

0 Comments