পাহাড়ি ঝর্ণায় গিয়ে নিখোঁজ মেহরাব হোসেনের ৩ দিন পর লাশ উদ্ধার

হেলাল উদ্দিন, উখিয়া থেকেঃ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাতছানিতে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলেন তরুণ যুবক মেহরাব হোসাইন (১৮)। কিন্তু পাহাড়ি ঝর্ণার রূপের মোহে হারিয়ে তিনি ফিরলেন না আর। নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর শুক্রবার (২০ জুন) বিকালে উখিয়া  উপজেলার রেজুখাল ব্রিজের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় তার নিথর দেহ।

উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের বাসিন্দা মেহরাব হোসাইন গত সোমবার (১৭ জুন) বান্দরবানের সৌনাইছড়ি ইউনিয়নের ‘ফাত্রাঝিড়ি বরইতলী ঝর্ণা’ দেখতে যান কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। সেদিন বিকেলে হঠাৎ পাহাড়ি ঢলে ঝর্ণার প্রবল স্রোতে ভেসে যান তিনি। নিখোঁজ হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও উদ্ধারকর্মীরা তিন দিন ধরে খোঁজাখুঁজি চালান। অবশেষে শুক্রবার বিকালে রেজুখাল ব্রিজের নিচে তার মরদেহ ভেসে উঠলে স্থানীয়'রা উদ্ধার করে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ‘ফাত্রাঝিড়ি ঝর্ণা’ স্বল্পপরিচিত হলেও ক্রমেই এটি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে বর্ষাকালে এই ঝর্ণাটি ভয়াবহ রূপ নেয়। পাহাড়ি ঢলে হঠাৎ পানির গতি ও গভীরতা বেড়ে যায়, যা অনভিজ্ঞ পর্যটকদের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

এ বিষয়ে স্থানীয় এক যুবক তামজিদ কবির বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, কিন্তু সেই সৌন্দর্য যদি প্রাণ কেড়ে নেয়, তাহলে সেটি দুর্ভাগ্যজনক। মেহরাবের মৃত্যুর ঘটনা হৃদয়বিদারক। তিনি আরও বলেন, এখনই যদি পর্যটন এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে আরও অনেক তরুণকে প্রাণ হারাতে হবে।

উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া এক স্বেচ্ছাসেবক জানান, বর্ষার সময় ঝর্ণার আশপাশের এলাকা খুবই বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। তবে কোনো ধরনের গাইড, সতর্কবার্তা, লাইফ জ্যাকেট বা বিপদ সংকেত ছাড়াই অনেকে সেখানে চলে যান। এতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা পর্যটকদের বারবার সতর্ক করছি। বিশেষ করে বর্ষাকালে পাহাড়ি ঝর্ণা ও খালের পাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য। কিন্তু অনেকেই সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে সেখানে যাচ্ছেন।

পর্যটন বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ নুরুল হাসান আযাদ বলেন.. বান্দরবান ও কক্সবাজার অঞ্চলের ঝর্ণা ও ট্রেইলগুলোতে এখনই সার্বিক পর্যটন নীতিমালা, নিরাপত্তা প্রটোকল, গাইডলাইন ও জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থার উন্নয়ন না করা হলে দুর্ঘটনার হার বাড়তেই থাকবে। প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত নির্দেশনা, প্রশিক্ষিত গাইড, সাইনবোর্ড, বিপদ সংকেত, এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

স্থানীরা বলেন, এই সব স্পট এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার পাওয়ায় তরুণ প্রজন্মের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। কিন্তু তাদের পর্যটন বিষয়ে সচেতনতা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জ্ঞান নেই। ফলে সামান্য অসতর্কতায় ঘটে যাচ্ছে মর্মান্তিক ঘটনা।

মেহরাবের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্বজনরা বারবার বলছেন, আমরা আর কোনো মেহরাবকে হারাতে চাই না। এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়, তাহলে হয়তো আর কোন মায়ের বুক খালি হবে না।

তারা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছেন, ফাত্রাঝিড়িসহ পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পর্যটন নীতিমালার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে। প্রয়োজনে এইসব এলাকায় বর্ষা মৌসুমে পর্যটকদের প্রবেশ সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করারও আহ্বান জানিয়েছেন।

মেহরাবের জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে এক ঝর্ণার প্রবাহে। কিন্তু এই মৃত্যু আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো পাহাড়ি পর্যটন স্থলগুলো কতটা অনিরাপদ হতে পারে। তার এই মৃত্যু যেন আরেকটি দুর্ঘটনার পূর্বাভাস না হয়—এটাই এখন সমাজ, প্রশাসন এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্ব।

Post a Comment

0 Comments