ঝিরি-নদী-সমুদ্রে বাড়ছে মৃত্যুহার: সচেতন হতে হবে এখনই

নাছির আহমেদ সৌরভ: শুরু হয়েছে বর্ষা মৌসুম। এই সময় যেমন নদ নদী, হাওর বাওড় পানি বারে তেমনি পর্যটক বাড়ে এসব অঞ্চলে। পানির গতিপ্রকীতি না বোঝার কারনে স্বাভাবিক ভাবেই মৃত্যু ঝুঁকি বারে এসব অঞ্চলে ।  বর্তমানে সাগর, নদী, খাল, হ্রদ কিংবা পাহাড়ি ঝর্ণায় ট্রাভেল করতে গিয়ে অনেক লোক মারা যাচ্ছে। এমন কি সাঁতার জেনেও সাঁতার কাটতে গিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। অথচ সচেতনতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে এই বিপদ অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। সাঁতার না জানলেও এই হার ৭০-৮০ % কমিয়ে আনা সম্ভব । 

চলুন জেনে নেই, পানিতে প্রাণহানির ৩টি প্রধান কারণ ও তা থেকে বাঁচার উপায়। 

পানিতে মৃত্যুর মূল কারন মূলত ৩ টি:

১-  সাঁতার না জানা:

  • অনেকেই সাঁতার না জেনেই পানিতে নেমে পড়েন। এটা একদমই সুইসাইডাল। নদ-নদী, সাগর, হাওর বাওড় কোনও সাধারণ বিষয় নয়। দূর থেকে সাভাবিক মনে হলেও সামান্য অসতর্কতায় মৃতু হতে পরে কয়েক মিনিটেই। 


২- পানির গতি-প্রকৃতি না বোঝা:

  • অনেক সময় সাঁতার জানা থাকলেও মানুষ স্রোতের ফাঁদ, নিচের টান (সাকশন), বা ফ্ল্যাশ ফ্লাডের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত থাকে না। সাঁতার জানলেও কোথায় নামা উচিত আর কথায় থাম উচিত তাও ওজনা । হয়তো আমাদের চোখের সামনে আমরা একটি ঝিরি, বহমান নদী বা শান্ত দেখতে সাগর দেখে নেমে পরি অনেক সময় বুঝতেই পারিনা এর মধ্যে লুকিয়ে আছে মৃত্যু ফাঁদ। পানির গতি প্রকিতি না বুঝে পানিতে নামার কারণে মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি। 

  • আবার একটিভ সাঁতারের সময় আমাদের শরীর প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। এই কার্বন ডাই-অক্সাইড রিলিজ করে অক্সিজেন নেয়াটা খুবই জরুরি। পানিতে এই অতীব জরুরি বিষয়টি করতে না পারও পানিতে মৃত্যুর অন্যতম কারণ। 

৩- অসতর্কতা ও নিয়ম না মানা:

  • পানিতে মৃত্যুর অন্যতম আরেকটি বড় কারন হলো নিয়ম না মানা। অনেক সময় আমরা সাঁতার না জেনেও লাইফ জ্যাকেট ছাড়া পানিতে নেমে যাই আবার ওচেনা জায়গায় লাফ দিয়ে বসি যা সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ । অনেকে পাহাড়ে ট্রাভেলিং করতে গিয়ে অনেক সময় ঝিরির পাশে বা ঝর্ণার পাশে কেম্প করি । বর্ষায় এসব অঞ্চলে কেম্প কড়া খুবই ঝুঁকি পূর্ণ । 


✅ কিভাবে কমানো যায় পানিতে প্রাণহানির ঝুঁকি? 


আমাদের দেশ মূলত নদী মাত্রিক। প্রায় প্রতীটি জেলায়ই নদী সহ রয়েছে আরও অনেক ওয়াটার বডি। আমরা যদি পানির সাথে বেচে থাকার বেসিক বিষয়গুলো জেনে নেই তাহলে ভ্রমণে অথবা এমনিতেও পানিতে মৃত্যু হার ৭০-৮০% কমিয়ে আনা সম্ভব। চলুন জেনে নেই কিভাবে আমরা পানির সাথে সাভাবিক মানিয়ে নিতে পারি ।  


১.  নিজের জন্য সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক করুন:

সাঁতার বিলাসিতা নয় নদী মাত্রিক এই দেশে এটি একটি অপরিহার্য জীবনদক্ষতা। পরিবার, গ্রাম, মহল্লা, স্কুল, ক্লাব সবাই মিলে এই উদ্যোগ নেয়া যেতে পরে। এক্ষেত্রে সরকারের ও এগিয়ে আশা উচিত। 

২. ট্রাভেলিং করার আগে নির্দিষ্ট এলাকার পানির প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা:

আমরা সাগর, নদী, ঝর্ণা বা হাওর- বাওড় যেখানেই যাইনা কেন। পানির প্রকিতি সম্পর্কে আমাদের গান থাক অত্তান্ত দরকারি একটি বিষয়। ঝিরি, সাগর বা জলপ্রবাহ কখনোই সাধারণ পুকুর বা সুইমিংপুল নয়। এগুলোতে পানির গভীরতা ও স্রোতের গতি মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে। স্রোতের নিচে ফাঁদ থাকে, থাকে ডিপ হোল বা সাকশন, যা অভিজ্ঞ সুইমারকেও বিপদে ফেলতে পারে।

আমরা যদি বোঝার চেষ্টা করি  কোথায় স্রোতের ফাঁদ  বা ডিপ হোল (হলো পানির নিচে থাকা হঠাৎ অতিরিক্ত গভীর জায়গা)  বা সাকসান (যেখানে পানি ঘুরতে থাকে এবং মাঝখানে টেনে নেয়)। অনেকে এইটিকে চোরা গর্ত”, ঘূর্ণি ফাঁদ, ও বলে থাকেন।  

আছে বা থাকতে পরে তাহলে আমরা খুব সহজেই এই বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে পারব। স্রোতের ফাঁদ হলো এমন একটি বিষয় যা অনেক সময় উপর থেকে দেখে বোঝার উপায় থাকেন। কিন্তু পানিতে থাকে তীব্র টান । শান্ত পানি ভেবে এই পানিতে নামলেই আপনি ভেসে যেতে পারেন গভীর। আবার অনেক সময় ঘোলা পানিতে এইগুলো বোঝার উপায় থাকেন তাই অবশ্যই  বৃষ্টি হচ্ছে, বা পানি ঘোলা এই সময় পানিতে একেবারেই উচিত নয়। একান্তই দরকার পড়লে নামলেও সাথে লাইভ জ্যাকেট, উইসেল, রোপ  সাথে রাখা অত্তান্ত অবস্যকীয় বিষয়। পানির গতি প্রকিতি সম্পর্কে স্থানীয় অভিজ্ঞ লোক বা  স্থানীয়দের থেকে জেনে নিন।

৩. সাতারে শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার অনুশীলন করুন:

আপনি যদি সাগরে, নদী নালা বা যে কোনও ওয়াটার বডিতে সাঁতার কাটতে চান তাহলে অবশ্যই আপনার বেসিক কিছু প্রশিক্ষণের নিয়ে নিতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে সাঁতারের সময় শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার কৌশল শিখুন। তাহলে আর যাই হক আপনি যে কোনও পরিস্থিতিতে দীর্ঘক্ষণ পানিতে ভেসে থাকতে পারবেন । সাথে  ভয় পেলেও যেন প্যানিক না হয় এমন মানসিক প্রস্তুতিও নিতে পারেন।  সাঁতারের সময় তৈরি হাওয়া কার্বডায় অক্সায়েড ছেড়ে অক্সিজেন নিতে পাড়ার সাধাওর্ন এই কৌশকটি হতে পরে আপনার জীবনের জীবন রক্ষাকারী একটি বিশেষ স্কিল। এটা নিশ্চিত ভাবেই পানির এক্সট্রিম সিটিউসনে আপনাকে দীর্ঘক্ষণ টিকিয়ে রাখবে।

৪. নিয়ম মানুন ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করুন:

বর্ষায় ট্রাভেলিংয়ে বিশেষ করে যদি এলাকাটিটি কোনও ওয়াটার বডি থাকে তাহলে  অবশ্যই আপনাকে লাইফ জ্যাকেট, হুইসেল, ও রোপ নিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় লাফানো অবশ্যই পরিহার করতে হবে। ছবি তোলার ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যেনো বেপরোয়া হয়ে না যান।

৫. প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ শুনুন:

স্থানীয় অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত গাইড, লাইফগার্ড অথবা ওপেন ওয়াটার সুইমারদের পরামর্শ নিতে পারেন। স্থানীয়রা অনেক কিছু জানেন তাই তাদের পরামর্শ খুবই মূল্যবান।

৬- শিশুদের জন্য করণীয়। 

অবশ্যই কোনও অবস্থাতেই সাথে থাক শিশুকে একা ছাড়বেননা। পানিতে নামতে দেয় পরিহার করুণ। এবং অবশ্যই পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে বের হবেন।

বর্ষায় যদি পাহাড়ে ট্রেকিং করার কথা ভাবেন তাহলে অবশ্যই যেই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে:


বর্ষায় ট্রাকিং পরিহার করা উত্তম। একান্তই দরকার হলে এই বিষয়গুলো অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত। 

- আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে বের হতে পারেন।
- খাল, ঝর্ণা বা নদীর পাশে ক্যাম্প করার আগে হাজার বার ভাবুন।
-  অবশ্যই উঁচু ও নিরাপদ স্থানে বিশ্রাম নিন।
-  স্থানীয়দের পরামর্শ অবশ্যই নিন।
-  গভীর ঝিরিতে হাঁটা এড়িয়ে চলুন।
-  ঝর্ণার নিচে দীর্ঘ সময় অবস্থান করবেন না।
-  ছবি তোলার ঝোঁক নিয়ন্ত্রণ করুন।
-  অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে পাহাড়ে আপনার পাশে বৃষ্টি না হলেও ঢল আসতে পারে।
- সুরক্ষিত গিয়ার (লাইফ জ্যাকেট, হুইসেল) সাথে রাখুন।
- কখনোই এক ট্রেকিং করবেননা। দল বেধে ট্রেকিং করুণ। 

হঠাৎ ফ্ল্যাশ ফ্লাড এলে অবশ্যই খালের উপর দিয়ে দৌড়ে পালাবেন না, পাথরের উপর দাঁড়িয়ে থাকবেন না এবং মোবাইল বা ব্যাগ বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবেন না

শেষ কথা:

সাঁতার জানলেও বাঁচা যায় না, যদি পানির আচরণ না জানা থাকে। আবার সাঁতার না জানলেও পানি মৃত্যু থেকে নিজেকে বাচিয়ে রাখা যায়। 

সাঁতার জানলেও আপনি বর্ষায় এবং যে কোনও রকম ঘোলা পানিতে সাঁতার পরিহার করুণ।
সতর্ক থাকুন, নিয়ম মানুন, নিজে বাঁচুন—অন্যকেও বাঁচান।

তবে সরকারের এই বিষয়ে এগিয়ে আশা উচিত। দেশে সুইমিং শেখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই এবং এটাও পানি মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারন। 


নাসির আহমেদ। 

ট্রাভেলার, ওপেন ওয়াটার সুইমার। 

প্রেসিডেন্ট - বাংলাদেশ ওপেন ওয়াটার সুইমিং - BOWS । 





Post a Comment

0 Comments