সীমান্তের অঘোষিত সম্রাট ডাকাত শাহীনের ডেরায় যৌথ বাহিনীর হানা: আগ্নেয়াস্ত্র, ওয়াকিটকি, জাল টাকার মেশিনসহ বিপুল পরিমান সরঞ্জাম উদ্ধার


আপন কন্ঠ রিপোর্ট ॥
অবশেষে কক্সবাজারের রামু গর্জনিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের অঘোষিত সম্রাট মায়ানমার সীমান্তের শীর্ষ চোরাকারবারী ও সন্ত্রাসী শাহীনুর রহমান শাহীন ওরফে ডাকাত শাহীনের ডেরায় অভিযান চালিয়েছে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও র‌্যাব বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

রোববার (২৫ মে) ভোর রাত ৪টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ ঘন্টার চলমান এই যৌথ অভিযানে অংশ নেন র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির বিপুল সংখ্যক সদস্য।

এ সময় ডাকাত শাহীনের নবনির্মিত বাড়ি থেকে ১৯ রাউন্ড বিভিন্ন রকমের রাইফেল-এর গুলির খোসা, ১টি জাল টাকা বানোর মেশিন, ২টি ১২ বোর কার্তুজসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র, গাঁজা, ওয়াকটকি সেট, ১টি কালো রংয়ের বাইনোকুলার, ২টি দা, ১টি ল্যাপটপ, ৪টি আইপি ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়েছে। তবে অভিযানের আগাম খবর পেয়ে ডাকাত শাহীন পালিয়ে যাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি ।

র‌্যাব ও পুলিশ সূত্র বলছে, প্রায় ১৯ মামলার পলাতক আসামি ডাকাত শাহীন। এর মধ্যে ৯টি ডাকাতি, ডাকাতি প্রস্তুতি ও ছিনতাই, ৪টি হত্যা মামলা, দুটি অস্ত্র মামলা, দুটি মাদক মামলা এবং অপর দুইটি অন্য মামলা। এছাড়া বিভিন্ন থানায় অসংখ্য জিডি রয়েছে।

শীর্ষ ডাকাত শাহীনুর রহমান ওরফে শাহীন ডাকাত। তিনি রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডস্থ মাঝির কাটা গ্রামের মোঃ ইসলামের পুত্র।

উদ্ধারকৃত আলামত প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণার্থে রামু থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানায় র‌্যাব।

জানা যায়, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত এলাকা বিশেষ করে গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, ঈদগড় ও বাইশারীর দেড় লক্ষাধিক মানুষ তার কাছে জিম্মি। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে অপ্রতিরোধ্যভাবে চলছে তার রাম রাজত্ব। তিনিই ঐ এলাকার স্বঘোষিত শাসক। টু-শব্দ করার সাহস কারো নাই। মতের বাইরে গেলেই ধরে নিয়ে গিয়ে দেয়া হয় কঠিন শাস্তি। প্রায়শঃই প্রকাশ্যে ভারী অস্ত্র উঁচিয়ে ফিল্মি স্টাইলে এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে নিজের অবস্থান জানান দেন ডাকাত শাহীন। প্রশাসনের শাসন চলে না এ অঞ্চলে। শাহিনের শাসনে চলে পুরো এলাকা, তার লাইফস্টাইল যেন তামিল সিনেমার বাস্তব কাহিনী। বলা চলে শাহিনের হাতে স্বাধীন দেশের পরাধীন এক ভূখন্ড, যেখানে আইন, প্রশাসন, সরকার সব কিছুই ডাকাত শাহীন।

তার মায়াবী চেহারা ও সুদর্শন শারীরিক গঠন দেখলে যে কেউ সহজে তার প্রতি বিমোহিত হবে। কিন্তু তার এই সুন্দর অবয়বে লুকিয়ে আছে নৃশংস এবং ভয়ঙ্কর এক দানবীয় চরিত্র। মানুষ তাকে নব্য এরশাদ সিকদার বলেও তুলনা করে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মিয়ানমারে সংঘাত শুরু হলে সীমান্ত দিয়ে এপারে অবৈধভাবে গরু প্রবেশ শুরু হলে চোরাচালান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ শাহীনের হাতে চলে যায়। এরপর থেকে সীমান্তে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সাথে নিয়মিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হত শাহীন ও তার গ্রুপের। সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান তথা রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির দখলে চলে গেলে ডাকাত শাহীন আরাকান আর্মির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। তারা সীমান্তের এপারে বাংলাদেশে চোরাচালান ব্যবসার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে শাহিনকেই বেছে নেন। যেহেতু শাহীনের বিশাল বাহিনী এবং অস্ত্র ভান্ডার রয়েছে, সেহেতু শাহিনের প্রতিই খুবিই আস্থাশীল আরাকান আর্মি। বর্তমানে শাহিনের মাধ্যমেই আরাকান আর্মি সীমান্তের এপারে অবর্ননীয় চোরাচালান করছে। এসব চোরাচালানের মধ্যে গরু-মহিষ,তার সাথে ভারি অস্ত্র, ইয়াবা,আইস, স্বর্ণের বার, সিগারেট, সুপারী উল্লেখযোগ্য। একই সাথে ডাকাত শাহিন এপার থেকে আরাকান আর্মির যাবতীয় রসদ যোগান দিচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানান, শাহীনের চোরাচালানে কেউ বাধা হয়ে দাড়ালে নিশ্চিত মৃত্যু, চোরাচালানকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েক মাসে দশটির মতো হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছে ডাকাত শাহীন। শাহীনের হাতে খুনের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে সর্বদা, জনসম্মুখে করা খুনের তথ্য মানুষ জানলেও লোকচক্ষুর অন্তরালে সংঘটিত  হত্যাকান্ডের পরিসংখ্যান থেকে যাচ্ছে আড়ালে। যুবক, বৃদ্ধ, নারী এমনকি পেটের অনাগত সন্তানও রেহায় পায়নি শাহীনের হাত থেকে।

সূত্র বলছে, চোরাচালান থেকে শাহীনের প্রতিদিনের আয় আনুমানিক ৫০ লক্ষ টাকার অধিক, যার অধিকাংশই তিনি প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে বিলি বন্টন করেন। এ কারণে প্রশাসন তার প্রতি এত উদাসীন ও নমনীয়তার মূল কারণ বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

সূত্রে জানা যায়, রামু-কক্সবাজার এবং নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার বিপদগামী যুবক, সাজাপ্রাপ্ত এবং দাগী আসামীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে শাহীন বাহিনী। পাহাড়ে রয়েছে ডাকাত শাহীনের বিশাল অস্ত্র ভাণ্ডার। সেখানে দেয়া হয় তার বাহিনীর কয়েক শত সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, রয়েছে টর্চার রুম, যেখানে প্রতিপক্ষকে ধরে নিয়ে গিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়।

স্থানীয় তথ্যসূত্রে জানা যায়, ঈদগড়ের ভয়ংকর ডাকাত কালু, কলিমুল্লাহসহ কয়েকজনের হাত ধরে ধরে শাহীনের অপরাধ জগতের সূত্রপাত। শুরুতে ঈদগড়- ঈদগাঁও সড়কে ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়ে জেলে যায় শাহীন। পরে জেল থেকে বের হয়ে ২০১২ সালের দিকে নিজেই একটি বাহিনী গঠন করে রামুর ঈদগড়, গর্জনিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ির রাবার বাগান মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় শুরু করেন। জোরপূর্বক চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মো: হারুনের রাবার বাগান সহ একাধিক মালিকের রাবার বাগান  দখল করে নিয়েছে এই গ্রুপটি। পরবর্তী সময়ে বাড়তে থাকে তার অপরাধনামা। প্রকাশ্য দিবালোকে অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি, চোরাচালান, দখলবাজি, লুটতরাজ, এমন কিছু বাকি নেই যা তার নিজস্ব ডাকাত বাহিনী দ্বারা সংগঠিত হয়নি।

পরবর্তীতে ২০১৪ সালের দিকে স্থানীয় সাংসদ ও হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমলের সংস্পর্শে আসেন শাহীন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, দ্বিগুণ উৎসাহে অপরাধ জগতে নিজের শক্ত অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। নিজেকে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করেন। যার ফলশ্রুতিতে সাংসদ কমল ডাকাত শাহীনের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থের সুবিধা নিতেন। এদিকে ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর শাহীন আরো বেশি বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন।


Post a Comment

0 Comments