ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে ৪ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজে হরিলুট!

জুলফিকার আলী ভুট্টো, চকরিয়া: কক্সবাজারের চকরিয়া ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে বিগত আওয়ামী সরকার আমলের লুটপাট প্রকল্পে ৬টি উন্নয়ন  কাজের বিপরীতে বরাদ্দ প্রায় ৪ কোটি টাকার কাজে ব্যাপক অনিয়ম-হরিলুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

অভিযোগে প্রকাশ, ঠিকাদার নির্দিষ্ট মেয়াদ ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পগুলোর কাজ সিকিভাগ সম্পন্ন না করলেও পুরো বিলের চেক ইস্যু করা হয়েছে। এছাড়া ১ জুন এসব প্রকল্পের কার্যাদেশ দেওয়ার পর কাজ শুরু না করেই সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ মনজুর আলম, বন্যপ্রানী জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা (চুনতি) নুরজাহান বেগম এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রামস্থ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজের যোগসাজশে প্রত্যেকটি প্রকল্পের অনুকূলে অতিরিক্ত কাজের (ভেরিয়েশন) কার্যাদেশ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলেও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে।  

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের উন্নয়নে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে ১১টি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য টেন্ডার আহবান করেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রামস্থ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ। ওই টেন্ডারে ব্যাপক জালিয়াতি হয়েছে জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বরাবর অভিযোগ করেন মেসার্স এম আলী এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স রাজীব ট্রেডার্স নামক দুটো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। 

তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। পরে তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন মর্মে প্রতিবেদন দাখিলের পর পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়।  পরবর্তীতে গত ২১ এপ্রিল দু'টি সাপ্লাই ও ৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য পুনরায় দরপত্র আহবান করেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ। এখানেও আগের মতো জালিয়াতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে জানিয়ে গত ১৪ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন মেসার্স এম আলী এন্টারপ্রাইজ।

তার অভিযোগ আমলে না নিয়ে প্রকল্প পরিচালক তাঁর পছন্দের ৬টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে মেসার্স রহিমা এন্টারপ্রাইজকে ফুড স্টোরেজ কাজ, মোজাদ্দিদ ফাউন্ডেশনকে গার্ভেজ ডিসপোজাল সাইট, মেসার্স আবুল হোসেন ভুইয়াকে টেরাকোটা অন বাউন্ডারি ওয়াল আফ টু এন্ট্রি গেইট, মেসার্স করিম এন্ড ব্রাদার্সকে আহত বন্যপ্রাণীদের আটক এবং উদ্ধারের জন্য ঘের নির্মাণ, মেসার্স এবি কনস্ট্রাকশনকে উদ্ধার কেন্দ্র এলাকায় প্রবেশ ও প্রস্থান গেট সহ অ্যাক্সেস রোড নেটওয়ার্ক নির্মাণ এবং ফ্রেন্ডস ইন্জিনিয়ারিং নামক প্রতিষ্টানকে মাংসাশী প্রাণীর ঘর নির্মাণ কাজের কার্যাদেশ প্রদান করেন গত ১ জুন। এসব কার্যাদেশে ৩০ জুনের মধ্যে কাজ সম্পাদনের কথা বলা হয়।   

এদিকে এই ৬টি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডারে ১০ পার্সেন্ট কম দরে কার্যাদেশ দেওয়ায় প্রাক্কলিত ব্যয় বরাদ্দের ৩৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা সরকারের সাশ্রয় হয়। কিন্তু ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনজুর আলম ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা (চুনতি) নুর জাহান এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হোম প্ল্যানিং ডেভলপমেন্ট লিমিটেডের যোগসাজশে সুপারিশ নিয়ে প্রকল্প গুলোর কোন ধরনের কাজ শুরু হওয়ার পূর্বেই গত ১৬ জুন এ ৬টি কাজে ওই বেঁচে যাওয়া ৩৮ লাখ ৬০ হাজার টাকার অতিরিক্ত কার্যাদেশ (ভেরিয়েশন) প্রদান করেন প্রকল্প পরিচালক আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ। 

গত ২৬ জুন এ প্রতিনিধিসহ ৪জন স্থানীয় সাংবাদিক সরজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গিয়েছিল - ৬টি অবকাঠামো উন্নয়ন কাজের মধ্যে ৩টি কাজের বেস প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্য একটি অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য শুধুমাত্র স্থান পরিষ্কার করা হয়েছে এবং মালামাল রাখার জন্য একটি শেড নির্মাণ  করা হচ্ছিল। নির্মাণাধীন ওই শেড নির্মাণে পার্কের মূল্যবান গর্জন গাছের চারা গাছ কেটে খুটি ও চালায় ব্যবহার করা হচ্ছিল।  উল্লেখ্য, এ পার্কটি দেশের প্রথম সাফারি পার্ক। যার আয়তন ২ হাজার ২২৩ একর। 

১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ পার্কে দেশ-বিদেশ থেকে আনা হয় নানা জাতের পশু-পাখি। ফলে দিন দিন পার্কটি দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। 

প্রতিষ্টার দুই দশক পর সাফারি পার্কটি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। এ জন্য গত দুই অর্থ বছরে ১২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ টাকা ব্যয়ে ১৮১টি আইটেম নির্মাণ-মেরামতের পরিকল্পনা করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে পার্কে নির্মাণ-মেরামত করা হয় ২০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর অর্থবছরে ২৮ কোটি টাকার কাজ। ১২৬ কোটি টাকার মধ্যে অবশিষ্ট কাজ ২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও তা গড়ায় ২৩-২৪ অর্থ বছর পর্যন্ত। নানা অনিয়মের কারনে এখনো তা পুরোপুরি সম্পন্ন করা যায় নি।  

এসব অনিয়মের ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রামস্থ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজকে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি রিসিভ করেননি। 

তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক মোঃ সানাউল্লাহ পাটোয়ারী বাস্তবায়নাধীন ৬টি উন্নয়ন  প্রকল্পের বিপরীতে চেক ইস্যু করার কথা স্বীকার করে জানান, শীঘ্রই এসব কাজ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Post a Comment

0 Comments