নিজস্ব প্রতিবেদক: দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যক্তিগত ভাবে টাকা আত্মসাৎ করে তা ফেরত না দিয়েই চাকুরীর মেয়াদ শেষে গতকাল ৩০ জুন শেষ কর্ম দিবস পার করলেন কক্সবাজার সদর উপজেলার কক্সবাজার সরকারী কলেজ সংলগ্ন মো: ইলিয়াছ মিয়া চৌ: উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত হোছাইন চৌধুরী। শুধু তাই নয় চলমান সময়ে বিদ্যালয়ের বকেয়া ব্যয় বাবদ মোটা অংকের বিল গোপনে ইউএনও কর্তৃক ছাড় করিয়ে নেয়ারও তদবির চালাচ্ছেন এমন অভিযোগে ফুঁসে উঠেছে অত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয়রা।
অভিযোগ রয়েছে- দীর্ঘ বছর ধরে একটানা প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগে নানা অনিয়ম দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন প্রধান শিক্ষক শওকত হোছাইন চৌধুরী। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর নিয়মিত অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন না করে নিজের খেয়াল খুশি মত বিদ্যালয়ের টাকা খরচ করেছেন। পরবর্তীতে ভুঁয়া বিল ভাউচার বানিয়ে বিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিলের লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এতোকিছুর পরও বিদ্যালয় তহবিলে রক্ষিত আরও অন্তত ২০ লক্ষাধিক টাকার কোন হিসাব না দিয়ে গতকাল ৩০ জুন চাকুরি থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রধান শিক্ষক শওকত হোসাইন।
এর আগে বিষয়টি অবগত করে আত্মসাতকৃত টাকা আদায় করার লক্ষ্যে ইলিয়াছ মিয়া চৌ: উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(শিক্ষা) ও পদাধিকার বলে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নীলুফা ইয়াসমিনের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও আত্মসাৎকৃত টাকা আদায় করতে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি জানিয়েছেন তারা।
দায়েরকৃত অভিযোগ ও অনুসন্ধানে জানা যায়, এমপিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় ব্যয়সহ নানা বিষয়ে আভ্যন্তরীন অডিট সম্পন্ন করা বাধ্যতামুলক। কিন্ত ইলিয়াছ মিয়া চৌ: উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত হোসাইন চৌধুরী ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একটিও অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করেননি। এবং নিজের খেয়ালখুশি মতো মনগড়া ভুঁয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন। যেহেতু বিধি মোতাবেক বিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা প্রধান শিক্ষক কর্তৃক খরচ করার এখতিয়ার রয়েছে, সেহেতু তিনি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির অগোচরেই কোন প্রকার হিসেব না দিয়ে তহবিলে রক্ষিত আরও নগদ প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা গায়েব করেন প্রধান শিক্ষক। বিষয়টি টের পেয়ে তৎকালীন পরিচালনা কমিটির সভাপতি মুজিবুর রহমানসহ কমিটির অপরাপর সদস্যরা অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বার বার তাগাদা দিলেও প্রধান শিক্ষক নানা অজুহাতে তা এড়িয়ে যান।
পরবর্তীতে তৎকালীন সভাপতি মুজিবুর রহমানের নির্দেশে আভ্যন্তরীন অডিট কমিটি গঠন করে ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয় এবং শওকত হোসাইনের দাখিল কৃত বিল-ভাউচার অনুযায়ী হিসেব নিকাশ করেই প্রতিবেদন দাখিল করেন। তার পরবর্তীতে অধিকতর স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সৈকত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে অপর একটি কমিটি অধিকতর তদন্ত পূর্বক বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ৯,৮৫,৩৯৩/-(নয় লক্ষ পঁচাশি হাজার তিনশত তিরানব্বই টাকা) আত্মসাৎ করেছে মর্মে প্রমাণিত হয়। যার ফলে অর্থ আত্মসাৎ ও অন্যান্য অভিযোগের দায়ে তৎকালীন কমিটি কর্তৃক ২০২০ সালের ২৯ আগস্ট অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক শওকত হোছাইন চৌধুরীকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করা হয় (অডিট রিপোর্ট সংরক্ষিত)।
বিদ্যলয়ের অপরাপর শিক্ষকরা জানান, বহিষ্কারের পর শওকত হোছাইন চৌধুরী তার অপরাধের তথ্য গোপন করে চাকুরীতে পুনর্বহালের লক্ষে চট্টগ্রাম আপিল এন্ড আর্বিট্রেশন বোর্ডে আবেদন করলে উক্ত বোর্ড রহস্যজনক ভাবে কোন প্রকার শুনানী ছাড়াই শওকত হোসাইনকে চাকুরিতে বহাল করতে একতরফা ভাবে রায় দেন।
এখানে উল্লেখ্য: উক্ত রায় পাওয়ার পরে শওকত হোসাইন বিদ্যালয়ে স্ব-ইচ্ছায় অনুপস্থিত থেকেও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিকে দোষী সাব্যস্ত করার অপচেষ্টায় পুনরায় তথ্য গোপন করে মহামান্য হাইকোর্টে আপীল করেন। মহামান্য হাইকোর্ট ও চট্টগ্রাম বোর্ডে আপিল এন্ড আর্বিট্রেশন বোর্ডের আদেশ ক্রমে তাঁকে পুনরায় বহাল পূর্বক উক্ত টাকা আদায় করার এবং পরবর্তী অর্থবছরের অডিট সম্পন্ন করার আদেশ দেন। উক্ত আদেশ অনুযায়ী তৎকালীন এডহক কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান হেলাল বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা প্রদান পূর্বক শওকত হোসাইনকে চাকুরিতে পূনর্বহাল করেন।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, তৎকালীন কমিটি মহামান্য হাই কোর্টের প্রতি সম্মান রেখে ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের আদেশক্রমে প্রধান শিক্ষক কে স্বপদে বহাল ও নিয়মিত বেতন ভাতা দিয়েছে যাহা বর্তমান পর্যন্ত বহাল আছে।
কিন্তু বহাল পরবর্তী তৎকালীন কমিটির সভাপতি প্রধান শিক্ষকের আত্মসাতকৃত টাকা পরিশোধের বিষয়ে একাধিকবার নোটিশ মারফত জানালেও তিনি অদ্যবধি কোন টাকা পরিশোধ করেন নাই।
বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, প্রধান শিক্ষক শওকত হোসাইন প্রথম ধাপে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ এবং ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭ বছর বিদ্যালয়ের তহবিল তসরুফ করার উদ্দেশ্যে নির্ধারিত বিধি-বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে একটিও অডিট সম্পন্ন করেননি। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের অডিট কার্যক্রম বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির বিশেষ উদ্যোগে সম্পন্ন করে তহবিল থেকে ৯,৮৫,৩৯৩/-(নয় লক্ষ পঁচাশি হাজার তিনশত তিরানব্বই টাকা) আত্মসাৎ করেছে মর্মে প্রমাণিত হয়। কিন্ত ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত পরবর্তী ৪ বছরের অডিট কার্যক্রম অদ্যাবধি সম্পন্ন করেননি প্রধান শিক্ষক শওকত হোসাইন চৌধুরী।
বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকরা জানান, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের তহবিল থেকে সরানো প্রায় পৌনে ১০ লাখ টাকা ছাড়াও ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করা হলে আরও প্রায় ১৫ লাখ টাকা তহবিলে ঘাটতি থাকতে পারে। তাই এসব টাকা পরিশোধের ভয়ে নানা অজুহাত দিয়ে অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করেননি প্রধান শিক্ষক শওকত হোসাইন।
নির্ভরযোগ্য সুত্র জানায়, বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে সব মিলে প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করে গতকাল ৩০ জুন প্রধান শিক্ষক শওকত হোসাইন চৌধুরী তার চাকুরির মেয়াদ শেষ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মহলে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের দাবী- বিদ্যালয়ের আত্মসাৎকৃত টাকা পরিশোধ না করে একজন প্রধান শিক্ষক কোন ভাবেই বিদায় নিতে পারেন না। এটি বিদ্যালয়ের দূর্নাম হওয়ার পাশাপাশি সমস্ত শিক্ষক সমাজকে কলঙ্কিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে ইলিয়াস মিয়া চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত হোসাইন চৌধুরীর মুঠোফোনে আপন কন্ঠকে জানান, তিনি বিদ্যালয়ের কোন টাকা আত্মসাৎ করেননি। তাকে হেনস্থা করতেই তার বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন। দীর্ঘ ৭ বছর অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন কেন করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে তিনি বলেন, বিভিন্ন সমস্যার কারনে অডিট সম্পন্ন করা না হলেও সকল হিসেব তিনি করে রেখেছেন। তিনি বলেন, তার কাছ থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষ কোন টাকা পাওনা নেই।
বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, গত ১৯ জুন উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে প্রধান শিক্ষকের অনিয়মের বিষয়ে শিক্ষক প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ইউএনও মহোদয়কে অবহিত করলেও তিনি তা কর্ণপাত করেননি। বরং তিনি বলেছেন-“এটা আমার দেখার বিষয় নয়”।
তারা আরও বলেন, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক বিদ্যালয় তহবিলের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি ইউএনও কোন ভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। আত্মসাৎকৃত টাকা আদায় না করে ৩০ জুন উক্ত প্রধান শিক্ষক শওকত হোসাইনের চাকুরি সমাপ্তিকরন সার্টিফিকেট প্রদান করলে ইউএনও’র বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু হবে বলে হুশিয়ারী দেন তারা।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী আপনকন্ঠকে জানান, “এই বিষয়ে আমি অবগত নই, এছাড়া এপর্যন্ত আমাকে কেউ অভিযোগও করেননি। তিনি বলেন, প্রধান শিক্ষক শওকত হোসাইন এর বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ রয়েছে তা আদালতেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সুতরাং এখানে আমার কিছুই করার নেই। তাছাড়া অভিযোগের বিষয়গুলো অনেক আগের, যা আমি কিছুই জানি না।”
বিগত ১২/০৫/২০২৫ ইং তারিখে রেজি: ডাক যোগে সদর ইউএনও বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হলেও নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী বলেন, এরকম কোন অভিযোগ তিনি পাননি। একাধিক প্রশ্নের উত্তরে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী বলেন, বিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা যদি কেউ আত্মসাৎ করে থাকেন তা আদায়ের যথেষ্ট উপায় রয়েছে। সুতরাং প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাৎ করে চলে গেলেও তা নিয়মানুযায়ী আদায় করার সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সাইদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, গত ২৬ জুন আমি একটা অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত পূর্বক বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
================================
0 Comments